অর্ণব সাহার কবিতা
স্বপ্নের কশেরুকা
১
অহংকারের বেশিটাই ফেনা তুমি সেই বাথটবে শুয়ে
ফাঁপা বুদ্বুদ ছুঁড়ে মেরেছ আমায় । অসম্মান
পিছলে গেছে দেয়ালে । আমি বর্ম, আমিই
প্রাইভেট আর্মি
গড়চিড়োলি থেকে একলা হেঁটে এসেছি
জলাজঙ্গল, পানাপুকুর, হাইরাইজ ও কলোনি-অধ্যুষিত এই
৪৪ বছর পেরিয়ে...
তুমি, আত্মসচেতন বালিকা মদের টেবিলে
বসে বলেছ—“যে প্রেম খুঁজেছেন, কখনও আসবে না”
কাউকে চাইনি আমি । বিশ্বাস করো
তোমার দেড় বিঘৎ কাচের হৃৎপিণ্ডে আমি
থুতু দিই । আমি, পেচ্ছাপ করি খোলা রাস্তায়...
২
তোমার স্তন, তোমার নাভি, জঙ্ঘা ও যোনিদেশ
তোমার স্নায়ু, কানের লতি, কোমরের খাঁজ
ঊরুতে গভীর ট্যাটু, যৌন-চুলে ছাঁটা হার্টসাইন
এখনও শেষরাতের আচ্ছন্ন ঘুম নষ্ট করে
কাত হয়ে শুয়ে রয়েছ । তোমার বিস্ফারিত পাছা
বিস্মৃতির তলদেশ খুঁজে দেখতে বলে । আমি সেই
কুয়োর অসম্ভব নীচে জ্যান্ত শোল মাছ দেখতে পাই
ওর তলায় কাদাজল । আত্মার জীবাশ্ম লিখে-রাখা
কতো দ্রাঘিমাংশে ওই জাহাজ ডুবেছিল ?
শত ডুবুরির চিৎকারে লবণাক্ত সামুদ্রিক জল
থিতিয়ে আছে । ওইখানে, লোহালক্করের ভাঙা স্তূপে
একজন মৃত শিল্পী তোমার ন্যাংটো শরীর আজও
এঁকে যায়
৩
গুহার ভিতরে এক রমণীর খোলা চুল শচীশের মুখে
পড়েছিল !
রোমশ জন্তু, যাকে অন্য কোনও ডাকনামে
সম্বোধনের কথা ভাবেওনি কেউ । তার ছায়া
হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে গ্রহণের সংকেত
দিয়ে যায়...
অলৌকিক ছোঁয়া পেয়ে পুরুষের শিশ্ন জেগে ওঠে
ওদের বাগানে পাখি গান গায় । আরও বিপন্নতা
নাবিকসমেত ওই স্টিমারের ভবিষ্যৎ কিনারগামী করে !
কালক্রম মেনে চাঁদ ডুবে যায় । চরাচরে ভরাকোটাল
হয়...
৪
এই পথ বারণাবতের । আটমাসের নির্বাসনে পাঠিয়ে আমার
সংকুচিত আত্মাকে খাঁচাবন্দী করেছে শিকারি !
বুকের মধ্যে দোল খায় একজোড়া কচি নরম হাত
যাকে সেই গতজন্মে ছেড়ে এসেছিলাম আমি...
অশ্রু এক অপার্থিব আখ্যান । সেই ভোরবেলায়
দুই বন্ধু পথের মোড়ে ধাক্কা খেয়ে ভিন্ন হয়ে গেল ।
হাঁড়ি আলাদা হয় একান্নবর্তী পরিবারের
একজন সাঁতার কাটে । বাকিরা তলিয়ে যেতে শেখে ।
এইভাবে কবিতা হবে না । বুনুয়েলের ‘অবস্কিওর
অবজেক্ট অফ ডিজায়ার’ ছবির মতো হাতফেরত
সারিবদ্ধ আঁতেলদের আড্ডায়, ওহে, কেউ
পিঠ চাপড়ে দিলেই ভেবো না কবিতা হচ্ছে !
কবিতা আসলে মুঘল জাফরির মতো । ভিতরে
সচ্ছন্দ আলোবাতাস খেলে...
৫
ভাবো, এক বিরতিহীন ঘুম ও স্বপ্নের তেপান্তর
মঠের জানলা দিয়ে দেখা যায় পরিব্রাজক লামা
ঝোলায় পাথেয় আর কবেকার গুপ্ত-ছিন্ন পুথি
ইতিহাসের পাতা থেকে ডেকে ওঠা বন্য টিট্টিভ
রক্তের উপত্যকায় হন্যে হয়ে মৃতদেহ খুঁজছে ক্লান্ত
শকুনেরা
ভাঙাচোরা পৃথিবী এক অলীক ভাগাড়
সন্ধে নামার আগে যখন স্ট্রিটল্যাম্প জ্বলে ওঠে
শান্ত প্রচ্ছায়া । আমি গতজন্ম থেকে হেঁটে এসে
রাস্তার মোড়ে দাঁড়াই । জীবনবীমার আলো
পঞ্চপ্রদীপের মতো শহরের ঢাল বেয়ে নামে !
কয়েকশ’ বামন সেই আধো-অন্ধকারে হেঁটে যায়...
৬
অন্যের প্রেমিকা । সঙ্গে ১৪ ফেব্রুয়ারির দুপুর
কাটিয়েছি । বালিহাঁস জলাশয় থেকে উড়ে গিয়ে
মেঘের শরীরে এঁকে দিয়েছে চিত্রার্পিত ডানা ।
কবরখানার ভাঙা পাথরে অতর্কিত ফুল
বলেছে—“নিষ্ঠুর হও । আরও স্বৈরাচারী হতে শেখো...”
বিবিধ ভারতী শুনে ভুলে যাওয়া মেদুর রাগিনী
অযথা স্বপ্নদৃশ্য এঁকে দেয় । ভরসন্ধেবেলা
যেন কার বুনো চুল মুখের উপরে ঝরে পড়ে...
পুড়ে-যাওয়া সিগারেট । অমীমাংসিত গল্পগুলো
একজোড়া তেতো ঠোঁটে স্বাদবিভ্রমের খোঁজ দেয় ।
আজ সে কোথায় ? তার ভরাট দু’বুকে
নীল যন্ত্রণার তাজা চিহ্ন দেখে আলো নিভে যায় !
৭
মগজের ভিতরটা উইপোকা খেয়ে ফেলেছে
যে ভাঙা সাইকেল আমি পুরোনো বাড়িতে ফেলে
এসেছিলাম
তার সমস্ত গতি আজ অন্ধকারে স্থির !
প্যাডেল ভাঙা । জং-ধরা চাকায় মরচে পড়েছে ।
মাথার উপর খোলা আকাশের নীচে একদিন
একলা দাঁড়িয়েছিলাম । কোনও শালগ্রামশিলাকে
দেখে মুরুব্বি মনে হয়নি ।
তাই কাঠের ঘোড়ার চেয়ে ঢের বেশি সহনীয় ছিল
পায়ে হেঁটে বাগবাজার । অলিগলিতে ঘোরা ।
উপরে চক্কর দিত আধিপত্যপ্রবণ শকুন :
নিঃশব্দে ফুটেজ তুলত স্বেচ্ছাচারী ড্রোন !
৮
মনশ্চিকিৎসক, তুমি প্রথম শেখালে আমি কীভাবে নিজের
ব্যাকড্রপ তৈরি করব । রসদ সংগ্রহ করব নিজেকে বাঁচাতে ।
এই শীত । এই ঝড়-বৃষ্টি সমাকীর্ণ মহাদেশে
যেখানে মানুষ আজও মেরুভল্লুকেরই মতো আদিম,
আগ্রাসী !
আমরা সব সম্ভাবনা বাইরে থেকে খুঁজে নিতে চাই
ভিতরমহলে রয়েছে আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার
পারলে গভীরে যাও । মগজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে
তুলে আনো মাংস-মজ্জা, বাতানুকূল ক্লেদ ও সমাধি
পারলে শিরার গায়ে আচমকা ব্লেড চালিয়ে দাও
ঘুম ছিঁড়ে ফেলো । ওটা আত্মসমর্পণ । ওকে মাথায়
তুলো না !
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন