সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
গদ্য

কোয়েরানটাইন


শবর























 অনন্ত  সময়-- যা বহমান । আমি তার থেকে একখণ্ড খামচে তুলে নেই। নিজেকে স্থাপন করি তার ওপর এবং আবিষ্কার করি একটি ভূখন্ড-- যার একমাত্র অধিপতি আমি। আমি রাজা, আমি মন্ত্রী, আমিই সেনাপতি, পাত্র, মিত্র, অমাত্য। আবার আমিই এই ভূখন্ডের একমাত্র প্রজা। আমি শাসক এবং শাসিত।স্বৈরাচারী এবং বিদ্রোহী। আমি এই ভূখন্ড শাসন করি, রক্ষা করি। দন্ড দেই। দন্ডিত হই। কারাগারে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করি। আবার একসময় সেই কারাগারে সুড়ঙ্গ খনন করে নিজেকে মুক্ত করি এবং রাজার বিরুদ্ধে ঘোষণা করি যুদ্ধ।
এইসব পরস্পর বিরোধী ঘটনা সমূহ এই ভূখন্ডে চলতে থাকে, চলতেই থাকে।উদ্ধত, দুর্বিনীতদের রাজা হিসেবে আমি বহিষ্কার করি, নির্বাসন দেই। যা কিছু সজীব, প্রাণবন্ত-- তা এই ভূখন্ডে নিষিদ্ধ, কেননা তারা সবসময়ই বিপজ্জনক। একবার একটা সিংহ এই ভূখন্ডে প্রবেশ করেছিল এবং আমি তৎক্ষনাৎ তাকে একটা খাটে রূপান্তরিত করেছিলাম। এইভাবে একদিন একটা চিতাবাঘকে আমি অতি সহজে টেবিলে এবং একটি শেয়ালকে চেয়ারে বদলে নিয়েছি। আমি বেশ মনে করতে পারি সেই হাতিটিকে যে আমার ভূখন্ডের প্রবেশদ্বার এর তোরনটি প্রায় ভেঙে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু ভেতরে ঢোকামাত্র আমি তাকে আলমারিতে পরিবর্তিত করেছিলাম। এখানে টেবিলের ওপর রাখা বইগুলো আসলে নানারকম পাখি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ভূখন্ডের যা কিছু দর্শনীয় তা ফ্রেমে বাধা হয়ে দেওয়ালে টাঙানো। এমনকি সতত চঞ্চল যে বেড়াল গুলি ক্রমাগত সীমান্ত টপকে পালাতে চায় তাদের নিখুঁত ভাবে আমি চটি জুতোয় রূপান্তরিত করেছি। এইভাবেই আমি সুরক্ষিত রাখি আমার ভূখন্ড। এখানে আমিই আইন, আমিই সংবিধান। অথচ প্রায়শই এই স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করি। সুরক্ষিত ভূখন্ডে আমি ঢুকিয়ে দেই টিকটিকি, মশা, মাছি, আরশোলাদের। তারা স্থিতাবস্থাকে ভেঙে দেয়, রাজাকে খিপ্ত করে তোলে। রাজাও ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। টিকটিকিদের লাঠি মেরে তাড়াতে থাকে। মশা মাছি আরশোলাদের মারার জন্য ব্যাপক হারে ব্যবহার করতে থাকে কীটনাশক স্প্রে। কিন্তু ছোট ছোট নাশকতাগুলি এই ভূখন্ডে চলতে থাকে। অত্যাচারী ও বিদ্রোহী কেউ কারো কে ছেড়ে দেয় না। লড়তে লড়তে একসময় রাজা দুর্বল হয়। বিদ্রোহীদের সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। এভাবেই রাজা এবং বিদ্রোহী পরস্পর পরস্পরের কাছে আসে। দুজনেই দুজনের আয়নায় দেখে নিজেদের মুখ। আবিষ্কার করে এই ভূখন্ডে তারা রাজা হোক বা বিদ্রোহী - - আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ।যারা ক্রমাগত বদল করে নিজেদের অবস্থান। তবে কি এই ভূখন্ড এক কল্পনা মাত্র? তবে কি সমস্ত দ্বন্দ্বের বীজ আমার ভেতরে নিহিত রয়েছে? আমার মৃত্যুই কি এই দ্বন্দ্বের একমাত্র মীমাংসা সূত্র? আমার মৃত্যুর সাথে সাথেই এই ভূখন্ডও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মিলে যাবে অনন্ত সময়ে।আজ মৃত্যুর খবর আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে, আমাকে তাড়িত করছে, ক্লান্ত করছে । বর্মে আবৃত হয়ে বসে অশক্ত,ভীত, জরাজীর্ণ আমি আজ কোন প্রতিপক্ষের জন্য অপেক্ষা করছি - - সে কি মৃত্যু । যে অস্ত্র দিয়ে একদিন অনন্ত সময় থেকে আমি এই ভূখন্ডকে তুলে এনেছিলাম আর বিশ্বাস করেছিলাম যে আমি অজেয়, অমর, সেই অস্ত্র আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি।না কি আমার বোধ, আমার চৈতন্যের ভিতরে ধীরে ধীরে ঐ অস্ত্রই  হয়ে উঠেছে আমার মৃত্যুবাণ।আর সমস্ত জীবন ধরে আমি শুধু করেছি আমিত্বের চর্চা। ও কে? আমার ভূখন্ডের প্রবেশদ্বারে ও কার ছায়া ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে? ও কি শেষ পর্যন্ত ঢুকে পড়বে ভিতরে, গ্রাস করে নেবে আমায়?  এসো তবে, আমার আমিত্বকে চূর্ন করে আমাকে গ্রহণ করো।  অনন্ত সময় স্রোতে আবার শুরু হোক আমার যাত্রা।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অরিত্র সান্যালের গুচ্ছ কবিতা  কয়েকটি লেখা                                 [ যা আমি গিলে খেয়েছি এতকাল প্রতিটি নিরুদ্দেশের অন্ধকার আমার মধ্যে আজ অনর্গল উসখুস করে কালো কালি ] ১। গর্ত থেকে পতন উপচে পড়ছে আমার বিশাল সব জাহাজ একে একে শূন্যতা গেঁজিয়ে ভেসে ওঠে মণি ঘিরে এক বন্ধ মাল্লা আমার আমার চারিদিক সম্পূর্ণ নয় এখনও ২। চার পাঁচটা অসম্পূর্ণ বাক্যের মধ্যে আছি এখন সে সব থেকে সুতো বেরিয়ে আছে হাওয়া নাড়ায় তাদের একটা পর্দা যেভাবে আমাদের ঘিরে রাখে বাইরে অনাদি শীতল কাল ৩। একটি প্রশ্নচিহ্নের আঁকশি নেমে আসে কে কে ফিরে যেতে চাও ফেলে আসা মাধ্যাকর্ষণে? খাদ থেকে এখন আমার স্বর হাউই ছুঁড়ল একটি- তারপর? জীবন অনন্ত শূন্যতায় উদ্ধৃত ৪। আমার পিছনে এখন তুমি এসে বসেছ-  শান্ত নিস্পন্দ ঝরে যাওয়া এখন শুধুই যতটুকু বয়ে নিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস আমি তোমার না-লেখার ...
দীপঙ্কর বাগচীর কবিতা paul gauguin  ঈশ্বর ও গাধার সংলাপ   সকল কাজের কাজ, ফেলে আসে আমাদের গাধা এ জীবন ঘূর্ণমান, এ জীবন বস্তুতঃই বাধা কে তবে ফিরেছে দূরে, সন্ধ্যা সূর্যে এতো রঙ করা বিষাক্ত বীজের ক্ষেত ছুঁয়ে আছে যেভাবে পাহারা এই রাত্রি নমাজের, এই রাত্রি প্রার্থনার ঘোরে উপাসনা ছাড়া কিছু, আছে নাকি দিনের অদূরে মানুষের মতো ঠোঁট, মানুষের মতো কেউ বসে আমার সমস্তবেলা কেটে যায় কীসের আবেশে ঋতুও যখন আসে ধস্ত হয়ে বিকারের প্রায় দূরে দূরে জ্বলে তারা, বালিকারা কোথায় হারায় দিনের ভিতরে দিন ডুবে গেলে গোলার্ধের পরে কে তবে এসেছ এই রাত্রিদিন এমন আষাঢ়ে এই রাত্রি নমাজের এই রাত্রি প্রার্থনার ঘোরে উপাসনা ছাড়া কিছু আছে নাকি দিনের অদূরে বাতাস কচুরিপানার দেশে, এসে গেছি অবশেষে ভাঙা বাড়িটার আলো বলেছিলে সব ভালো কোন পথে তোমাকে হারাই  আমার তো কিছু নাই , অন্ধকার বনে তাই একা একা ঘুরে গেছি সব কিছু মিছি মিছি বাতাসের দোলা লেগে ,এসেছে সবাই যতো ভাবি এলোমেলো ,কুয়াশায় কারা এলো ঝোড়ো হাওয়া বুকে নিয়ে এপাড়া ওপাড়া দিয়ে উড়ে যায় টিন ছাদ ,দেখো সাঁই সাঁই তুমি বলেছ...
পাঠ প্রতিক্রিয়া অতীতের সাথে চলতে থাকা নিরন্তর কথোপকথন         সৌরভ বাঁক দ্য কলিং অব হিস্টরি / স্যর যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ এম্পায়ার অব ট্রুথ। দীপেশ চক্রবর্তী।পার্মানেন্ট ব্ল্যাক,২০১৫, ৫৯৫। "Reading is traveling without the bother of baggage."                             ( Emilio Salgari) লকডাউনের শুরুতেই রামচন্দ্র গুহের একটি সম্পাদকীয় কলমে পড়া এই লাইনটা বেশ মনে ধরলো , মনে পড়লো  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে" গানটির কথা । সুতরাং আমিও বইকে অবলম্বন করে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলাম । ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমাদের যা অভ্যাস সেই মত টাইম ট্রাভেল করবো বলেই মনস্থ করলাম । অর্থাৎ বর্তমানে বসে অতীতের একটি নির্দিষ্ট সময়ের  বিশেষ একটি প্রক্রিয়াকে বুঝবো । এক্ষেত্রে আমার অবলম্বন হল দীপেশ চক্রবর্তীর The Calling of History বইটি। আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত তিনশো চার পাতার বইটির আলোচনা কাল বিংশ শতাব্দীর প্রথ...