শুভদীপ নায়কের কবিতা
ছবিঃ উইলিয়াম ব্লেক |
বীজ
১
এই যে গোপনবীজ বাতাসে উড়ে আসে, যার পতন হবে বারান্দার ফাটলে, ফুটে উঠবে গাছ, বসতবাড়ির কয়েকপুরুষের সত্যি,--- তাকে চিনেছি আমি । একদিন সৈনিক ছিলাম, পরাজয়ে ভেসে উঠে কাঠের কফিনে ছুটে আসি ঘরে, অসংখ্য ফাঁকে । লোহার লাটিম আমি, আমার আত্মতৃপ্তির কারণ হয়ে জমে থাকে আমারই বদঅভ্যাস । নিকটস্মৃতির কথা ভুলে আমি লিখতে বসি স্পর্শ, অবিরাম ধোঁয়া আর হাঁসের সাঁতার । বসে আছি আড়ালে, বসে আছি ঢালু রোদের সকালে । আমারও বাসনা ছিল খড়ের গাদায়, মহুয়ার রসে, রেলস্টেশনে । জ্যোৎস্নাকে অবজ্ঞা করে আমি কেবলই দিয়েছি হত্যার আদেশ । খারিজ করেছি যাকে, শুধু সেই--- মানেনি আমাকে ।
আমি যার অন্তর্গত, ভূখণ্ড জলের তলায় তার এতকাল নিয়োজিত । আমি যার কর্তব্যহীন, সেই অফুরান আশা সমস্ত শরীর নিয়েই চিন্তিত । শাখা থেকে কেউ যদি ছিঁড়ে নিত আমাকে, শুকিয়ে, কুলের ত্বকের মতো ফেটে গিয়ে পড়ে থাকতাম স্বস্তিতে, অবসরকালে । এইমাত্র নামলাম মেঘ থেকে, এইমাত্র ঘটে গেল যা ঠেকিয়েছি রোজ, খসে পড়ে ভেঙে গেল কঠিন শপথ । হতে পারত বীজ, ফিরে যেতে পারত সূচারু ফাটলে, যেমনটা হয়েছিল, যেমনটা হোক তুমি ছাড়া আর কেউ চায়নি । তোমাকে আনা হল এয়োদের দলে, আমাকে বদলি করা হল দেশ বেড়ানোর কাজে । রাত্রে যখন তুমি, দিনে তখন আমি ত্রিপলের নিচে, বয়ে আনা অস্ত্রে, জমানো ওষুধে । বীজ, একদিন পালিয়ে যাব সতর্কে, খুঁজে ফেরার আগে, এক কাপড়ে, অন্ধকারে, রুক্ষ চুল আর পুরনো চিঠিতে । যেভাবে এসেছিলে বায়ুর ক্ষুব্ধ বেগে, নুনের পাহাড়ে, সেভাবেই বেরিয়ে পড়ব ভুলভ্রান্তি নিয়ে । এ অববাহিকা ফেলে চলে যাব পাখির প্রদেশে ।
২
পাকা ফলের মতো নিজেকে উৎসর্গ করেছি পাখির ঠোঁটে । ঠুকরে খেয়েছে সে, ফিরে গেছে অন্য ডালে, ভিন্ন গাছে । সেবার এখানে বন্যা হয়েছিল, পথঘাট ডুবে ছিল অচিন্ত্যনগরে । দোকানপাট বন্ধ, চাতালের ওপর এসে শুয়েছে কুকুর । ক্ষুধার্ত সাপ ব্যাঙের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটেছে । আমাদের একতলা ডুবেছিল, ভেঙে পড়েছিল সম্বন্ধ, আত্মীয়তা, বৈচিত্রবোধ । ভুলে গিয়েছি তোমার শাড়ির রঙ কী ছিল তখন ! ভুলে গিয়েছি আমার গানের খাতা ভেসে গেছে কি না ! মেয়ের গোপন প্রেমিক, তার কোনো খোঁজ ছিল কি না,--হিসেব রাখিনি । কাচের বাসন, চটিজুতো, আসবাব,---এসব কোথায় ছিল, আমি তো দেখিনি !
ভুল হয়েছিল, শুরুতেই গাঁথা ছিল আলাপের বাঁধ, তাই প্রবেশ করেনি সন্ধান, বাড়েনি জল । বহুস্বপ্ন উদ্বেগের, বহুস্বর ভাঙা অথচ অরক্ষিত । সুর, আর বোলো না আমাকে, কবে যেন বেঁধেছি সেতারে, আবহে । নদীঘাট এক হয়ে মিশে ছিল চোখের ভিতরে । আজ, এতদিন পর,---বেঁচে আছে মন্দিরতলা । লুপ্ত জলের ঢেউ জড়িয়ে রেখেছে তাকে । কালস্রোত, ক্ষয়শিলা, স্ত্রীয়ের নরম চুল, সবকিছু ভুলেছি সেদিন । ভুলিনি পোড়াবীজ, কেবলই তোমাকে ।
৩
এল ডাকহরকরা, এল নিয়তিনির্দিষ্ট অনতিকাল, এল সমূহ জীবনভর ক্ষতি, প্রলাপ, বিস্তৃতি, হাতছানি ,গাছে গাছে ফুটন্ত গোলাপ ,—যারা ভেসেছিল সুদূরে, ফিরে এল । কথা বলো— ও পরিণতিহীন বীজ, কথা বলো । কথা বলো রক্তে, তুমি তো জাতীয়তাবাদী, তুমিই হাহাকার, উঠে এসো মৃত সন্তানের মতো, এসো শোভাযাত্রায়, ঢালু রোদের গর্ভে । কে কার চেয়ে বেশি অরণ্য আজ ? কে বেশি ভিজেছি ধর্মশোকে ? ফোয়ারা পেতেছি, তুমিও মেলে ধরো ইতর আঁচল, দাও প্রবঞ্চনা, — তোমারই কুসুমভ্রূণ গেঁথে থাকে গভীরে, বৃদ্ধি পায় না । নষ্ট হোক তোমার খেলা । পালক জ্বলুক আঘাতে । যে তুমি উপস্থিত নও, সেই তুমি বেঁচে আছ মাটির ভিতরে, পাতার আড়ালে । তোমার শিরায় ফুটেছে চোখ, সেই চোখ চুরি করে দৃষ্টি পায় অন্ধপুরুষ । এসেছে ডুমুরগাছ, ছিঁড়েছে সূতীবস্ত্র, লেগেছে অপবাদ, —তোমাকে দেখবে বলে জমায়েত হয়ে আছে ধরণির লোভাতুর ঘাস । মুখোমুখি তুমি আর সোনালি জরির চাঁদ,— ফুটে ওঠে ঘন দুধ, প্রজন্মবেদনা, আয়ুস্বর, নিরালোক চেতনা,— যা কিছু হারিয়েছে, প্রিয় বীজ,— তুমি কি সেসব খোঁজো না !
৪
ভিজে নুনের সঙ্গে মাখামাখি, তারপর ধরা পড়ি উনুন নেভানো মেয়েটার চোখে, ধোঁয়াতে, ছায়ার প্রকোপে, শালের বাগানে, কংসাবতীর ঘাটে । জন্ম ভাসে, নেচে ওঠে রক্তজালক, ঝরে যায় বিবর্ণ পাতা, বিকেলে ঘনিয়ে আসে ঝড়, —‘কেন আমি ছুঁয়েছি তাকে যে আমার সম্পদ নয় ?’ শতপ্রশ্ন রাগে, মাইলখানেক দূর গোপনে গোপনে । বহিষ্কৃত আমি, মানুষ জানিয়ে গেল ঘটেনি যা বহুকাল আগে, তাই নাকি ঘটে গেছে গতকাল,—দেখার অভাবে !
এ শরীরে চাই টালবাহানা, এ মনে চাই অনিশ্চিত দ্বিধা, তাই পুবের আকাশে জেগে উঠে হেলে থাকি পশ্চিমা কাঁধে । ঐ কি রিমার মুখ ? চেয়ে আছে অসুখে, প্রশ্নে । ওর হাতে মরা ফল, আতসবাজির গন্ধ লেগে থাকে ওর ছেড়ে রাখা কাপড়ে । সেই কবে মুছে দেওয়া ক্ষত, স্মৃতিতে জ্বেলেছে টান । আজ ওকে আগুনে পেয়েছে, স্বপ্নে নামে তুমুল বর্ষা । রক্তচন্দনের ফোঁটা, বিচরণ, মৃতদের হাড়গোড়, সবই চাই । তাই, নৃশংস স্মৃতি, হতাশার চোখ মুছে বেড়ে ওঠে গাছ, আগাগোড়া লজ্জা ছাড়িয়ে ।
৫
কাঠপাখিটার সম্মতি নেই । তবু তাকে উড়তে হচ্ছে, বসতে হচ্ছে বৃক্ষশাখায়, পার হতে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত জঙ্গল । এখনও সে মরুভূমির খোঁজে, এখনও সে বিদর্ভ নগরে । গাঙচিল তাড়া করে তাকে, বেদেনির মেয়ে তাকে পোষে, গম দেয়, ফল দেয় কেটে, যা তার বেশি মনে হয় । আসলে সে ব্যথার সমান । আসলে সে পড়ে নেয় কিংশুক অক্ষরমালা, পাপের শীতল জল, মানুষের শুকনো অতীত । পাখি, তোমার জীবনে নেই টানা রোদ, নেই রঙিন ব্লাউজ, বইগুলো পুড়ে গেছে আগুনে, ছত্রমেঘে, আশু কর্তব্যে । নিমগাছ একদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল লজ্জায়, তারপরে কুণ্ঠায় তুমিও তাকে । সেইমতো শুরু হল অনাচার, সাক্ষাৎ । কখনও টিলার ধারে, কখনও পাহাড়ে, ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেওয়া ঠোঁটগুলো ঘিরে ফ্যালে । তবুও বিকার নেই, সম্প্রীতি খুঁজে ফেরে বহুবার শুধুই তোমাকে । এখনও কি প্রশ্নোত্তর তৈরি করো, আর তার মাঝে ফুটে ওঠে অকথিত ছবি ? আজ তুমি ভাঙা দরজার কোণে বাসা নিয়েছ, পালক ডুবেছে রঙে, দোষ পেয়েছ দোয়াতের সম্মানে । যে স্মৃতি ডানার নিয়ন্ত্রণে, তুমি তাকে পেড়ে আনো চোখে । বিবাহপ্রস্তাব, ধুলোমাখা সহবাস, আদর-আছিলা টান, সর্বনাশ,--- এসব ভুলেছ তুমি, সম্মতি ছিল কোনোকালে, আজ নেই । চেহারা বেড়েছে আজ ইন্দ্রিয়বোধে, গ্রহ-নক্ষত্রের সাজে । পাখি, মাটির হাঁড়ির মতো কোনও দিন যদি ভেঙে যেতে হয় তৃষ্ণার কাছে, তুমি যাবে ?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন