সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আত্মমুকুর 


দীপঙ্করবাগচী

আমি বিশ্বাস করি ঐতিহ্য বিযুক্ত হয়ে কোনো শিল্প আন্দোলনই তার মূলকে খুঁজে পায় না। সে কারণেই তো বিষ্ণু দে বলেছিলেন 'শিকড়ে' জল সিঞ্চনের কথা। ইয়োরোপীয় কবিতার ক্ষেত্রেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। শিকড়ে জল দান না করলে পরবর্তী বিকাশ মাঝপথে থেমে যেতে বাধ্য। কিন্তু একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা শিল্পের ইতিহাসে খুঁজতে চাওয়া একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইয়োরোপীয় সাহিত্যে বিশেষত ঔপনিবেশিকতার দৌলতে আমরা প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালি নব্য শিক্ষিত মানুষেরা ইংরেজি কাব্য সাহিত্যকেই বুঝেছি। ফলে রোম্যান্টিক শিল্পের ঐতিহ্য আমরা আবিষ্কার করেছিলাম মধ্যযুগের ত্রুবাদুর, প্রভসাঁল কিংবা পরবর্তীকালের প্রি-র‍্যাফেলাইট যুগের বা তার পরবর্তীকালের কাব্য ও চিত্র শিল্পের ভিতরে, এপ্রসঙ্গে মেটাফিসিকাল কবিদের কথা সযত্নে এড়িয়ে গেলেও, আমরা উঠে আসতে দেখব অলিভার গোল্ডস্মিথ, সুইন বার্ণ এবং ঠিক এর পরবর্তী সময়ে অসাধারণ মহৎ ও শ্রেষ্ঠ কবি এবং চিত্রশিল্পী উইলিয়াম ব্লেক কে। সাহিত্যের ইতিহাসকারদের মতে যিনি ইংরেজ রোম্যান্টিক কাব্য আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ পঞ্চকদের সবচেয়ে অগ্রজ উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের থেকে ঠিক ষোলো বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই যে, এই মহৎ 'হ্রদ কবিরা' ( Lake Poets) তাঁকে আদৌ চিনতেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে শিল্প ঐতিহাসিকদের মনে।
  
      অতএব, ঠিক একই ভাবে অন্যান্য ইউরোপীয় সাহিত্যেও বিশেষ করে যখন আমরা ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে ফরাসী, ইতালীয়, কিংবা আমেরিকান সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু    করি তখনও একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, রোম্যান্টিকতা শুধু ইংরেজ কবিদেরই একচেটিয়া বিষয় নয়, বরং, সার্বিক ভাবে সমগ্রপৃথিবীর কাব্য শিল্পকেই এই আন্দোলন, এই ভাবনা বারবার আলোড়িত করেছে। কোনো শিল্প ধ্রুপদী,  রোম্যান্টিক না আধুনিক তা নিয়ে ভাবতে গেলে এটা মনে রাখা দরকার যে, এ জাতীয় বিভাজন কোনো অনড় বিষয় নয়। ধ্রুপদী সাহিত্যের ভিতরেও রোম্যান্টিক ও আধুনিকতার লক্ষণ প্রবল মাত্রায় থাকতে পারে। ঠিক সেভাবেই রোম্যান্টিকতার ভিতরে এবং তার প্রয়োগেও ধ্রুপদী আর আধুনিকের লক্ষ্মণ প্রকাশিত হতে পারে। আবার একইভাবে তত্ত্বগত আধুনিকতার ক্ষেত্রেও পূর্বের দুটি ঘটনা একই ভাবে কাজ করতে পারে। এর অজস্র উদাহরণ আমরা গ্যয়টে, স্লেগেল কিংবা বেনেদিত্তো ক্রোচে হয়ে পরবর্তীকালে হারমেনিউটিক্স-এর অন্যতম মুখপত্র দার্শনিক হ্যানস গেয়োর্গ গাডামার কিংবা স্লাইয়ের মাখেরের রচনায় অথবা হেগেল থেকে ওয়াল্টার পেটার বা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের আলোচনায় কিংবা ফ্রাঙ্ক কারমদের ' রোমান্টিক ইমেজ' নামক গ্রন্থে আমরা এইসকল বিষয় কোথাও প্রত্যক্ষ বা কোথাও পরোক্ষভাবে বুনে উঠতে দেখি।

     সুতরাং, বাংলা কবিতা আজকে সর্ব অর্থেই বিশ্ব কবিতার সঙ্গে যুক্ত ইয়োরোপীয় উত্তরাধুনিক ( Post modern) দার্শনিক প্রত্যয়ের একটি বিশেষ দিক, – তা নিঃসন্দেহে, ঐতিহাসিক আধুনিকতার ওপারে চলে যাওয়ার চেষ্টা। অর্থাৎ কালগত আধুনিকতার বাইরে পৌঁছনোর এক প্রচেষ্টা, আর এই কাজ করতে গেলে ;আমাদের নিঃসন্দেহে খুঁজে দেখতে হবে, বাংলা কবিতার ও বিশ্ব কবিতার রোম্যান্টিকতার মূল স্বরূপটিকে।আর এখান থেকেই আমরা দেখবো— আগামী দিনের বাংলা কবিতার নব্য রোম্যান্টিকতার জয় যাত্রার মানচিত্রকে। তা নাহলে, শিল্পবীক্ষাহীন অশিক্ষিত কবি ও পাঠকদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কবিতার সাড়ে সর্বনাশ ঘটাবে। যদিও কবির কোনো দায় নেই সমাজ পরিবর্তনে। কিন্তু আজকের তরুণ লেখক হিসাবে, আমরা যেভাবে শিল্প ইতিহাসকে পাঠ করছি, তার নিরিখেই ক্রমাগত একথা বোঝার চেষ্টা করছি যে ৫০ পয়সার কাগজ আর ৫ টাকার একটি কলম কিনে সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পটি গড়ে তুলবো,  আর এই অক্ষম প্রচেষ্টা অদীক্ষিত পাঠক ও শিল্পের ভাষায় অর্ধশিক্ষিত স্বঘোষিত কবিরা ক্রমাগত করে চলেছেন, সে বিষয়ে আমাদের একটি প্রবল 'না'  এইসময়ের সার্বিক কাব্য ও শিল্পচর্চার সম্পর্কে রয়েছে। এবং  এ-অবস্থা পরিবর্তিত না হলে ; আগামী দিন গুলিতেও এর প্রতাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এই মুহূর্তে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি পঙক্তি মনে পড়লেই, সঙ্গে  সঙ্গে আমাদের পাঠক ও আমাদের মত শিল্প কবিতা প্রচেষ্টাকারীরা বুঝতে পারবেন, তথাকথিত  'স্বভাবকবি' শক্তি চট্টোপাধ্যায় কতো গভীরভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাব্য ও শিল্প দর্শনকে কী অপূর্বভাবে আত্মসাৎ করেছিলেন। 

 "ভেবেছিলেন শোপেনহাওয়ার হৃদয় থেকে কিচ্ছু পাওয়ার সময় নাই ।
 সকাল থেকে তাই তো ইচ্ছে এক ধরনের সাহস দিচ্ছে উড়ে না যাই "                                                                                                             

মন্তব্যসমূহ

  1. আপনি বলছেন ইউরোপীয় পোষ্ট-মর্ডানিজমের একটি দিক বাংলা কবিতা.... এর মানে কি বলতে চাইলেন,যে বাংলা উত্তর আধুনিক কবিতার অণুপ্রেরণা পাশ্চাত্য??

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অরিত্র সান্যালের গুচ্ছ কবিতা  কয়েকটি লেখা                                 [ যা আমি গিলে খেয়েছি এতকাল প্রতিটি নিরুদ্দেশের অন্ধকার আমার মধ্যে আজ অনর্গল উসখুস করে কালো কালি ] ১। গর্ত থেকে পতন উপচে পড়ছে আমার বিশাল সব জাহাজ একে একে শূন্যতা গেঁজিয়ে ভেসে ওঠে মণি ঘিরে এক বন্ধ মাল্লা আমার আমার চারিদিক সম্পূর্ণ নয় এখনও ২। চার পাঁচটা অসম্পূর্ণ বাক্যের মধ্যে আছি এখন সে সব থেকে সুতো বেরিয়ে আছে হাওয়া নাড়ায় তাদের একটা পর্দা যেভাবে আমাদের ঘিরে রাখে বাইরে অনাদি শীতল কাল ৩। একটি প্রশ্নচিহ্নের আঁকশি নেমে আসে কে কে ফিরে যেতে চাও ফেলে আসা মাধ্যাকর্ষণে? খাদ থেকে এখন আমার স্বর হাউই ছুঁড়ল একটি- তারপর? জীবন অনন্ত শূন্যতায় উদ্ধৃত ৪। আমার পিছনে এখন তুমি এসে বসেছ-  শান্ত নিস্পন্দ ঝরে যাওয়া এখন শুধুই যতটুকু বয়ে নিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস আমি তোমার না-লেখার ...
দীপঙ্কর বাগচীর কবিতা paul gauguin  ঈশ্বর ও গাধার সংলাপ   সকল কাজের কাজ, ফেলে আসে আমাদের গাধা এ জীবন ঘূর্ণমান, এ জীবন বস্তুতঃই বাধা কে তবে ফিরেছে দূরে, সন্ধ্যা সূর্যে এতো রঙ করা বিষাক্ত বীজের ক্ষেত ছুঁয়ে আছে যেভাবে পাহারা এই রাত্রি নমাজের, এই রাত্রি প্রার্থনার ঘোরে উপাসনা ছাড়া কিছু, আছে নাকি দিনের অদূরে মানুষের মতো ঠোঁট, মানুষের মতো কেউ বসে আমার সমস্তবেলা কেটে যায় কীসের আবেশে ঋতুও যখন আসে ধস্ত হয়ে বিকারের প্রায় দূরে দূরে জ্বলে তারা, বালিকারা কোথায় হারায় দিনের ভিতরে দিন ডুবে গেলে গোলার্ধের পরে কে তবে এসেছ এই রাত্রিদিন এমন আষাঢ়ে এই রাত্রি নমাজের এই রাত্রি প্রার্থনার ঘোরে উপাসনা ছাড়া কিছু আছে নাকি দিনের অদূরে বাতাস কচুরিপানার দেশে, এসে গেছি অবশেষে ভাঙা বাড়িটার আলো বলেছিলে সব ভালো কোন পথে তোমাকে হারাই  আমার তো কিছু নাই , অন্ধকার বনে তাই একা একা ঘুরে গেছি সব কিছু মিছি মিছি বাতাসের দোলা লেগে ,এসেছে সবাই যতো ভাবি এলোমেলো ,কুয়াশায় কারা এলো ঝোড়ো হাওয়া বুকে নিয়ে এপাড়া ওপাড়া দিয়ে উড়ে যায় টিন ছাদ ,দেখো সাঁই সাঁই তুমি বলেছ...
পাঠ প্রতিক্রিয়া অতীতের সাথে চলতে থাকা নিরন্তর কথোপকথন         সৌরভ বাঁক দ্য কলিং অব হিস্টরি / স্যর যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ এম্পায়ার অব ট্রুথ। দীপেশ চক্রবর্তী।পার্মানেন্ট ব্ল্যাক,২০১৫, ৫৯৫। "Reading is traveling without the bother of baggage."                             ( Emilio Salgari) লকডাউনের শুরুতেই রামচন্দ্র গুহের একটি সম্পাদকীয় কলমে পড়া এই লাইনটা বেশ মনে ধরলো , মনে পড়লো  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে" গানটির কথা । সুতরাং আমিও বইকে অবলম্বন করে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলাম । ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমাদের যা অভ্যাস সেই মত টাইম ট্রাভেল করবো বলেই মনস্থ করলাম । অর্থাৎ বর্তমানে বসে অতীতের একটি নির্দিষ্ট সময়ের  বিশেষ একটি প্রক্রিয়াকে বুঝবো । এক্ষেত্রে আমার অবলম্বন হল দীপেশ চক্রবর্তীর The Calling of History বইটি। আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত তিনশো চার পাতার বইটির আলোচনা কাল বিংশ শতাব্দীর প্রথ...