‘পরিবেশ ও মার্কসবাদ – ভারতীয় প্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য’
অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
৮ই এপ্রিল, ২০২০। সেই ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন। এবার সেই একই যমুনা নদীর ছবি। টলে টলে পরিষ্কার জল, দূষণের লেশমাত্র নেই। আগের মতো না হলেও, এই ছবিটি নিয়েও নেহাত কম চর্চা করলেন না নেটিজেনরা। তবে ভাষ্য কিন্তু সেই একই রইল। মানুষ দায়ী এই দূষণের জন্য। ‘করোনা নয়, মানুষই হল আসল ভাইরাস !’ এইধরনের বক্তব্যও যথেষ্ট শোনা গেল এদিক ওদিক থেকে।
লক্ষ্য করার বিষয় দূষণ ও দূষণহীনতা এই দুয়ের জন্যই অধিকাংশ মানুষ মানব-চরিত্রকে দায়ী করলেন, উৎপাদন ব্যবস্থাকে নয়। যেন এই ধরণের বিষাক্ত ফেনার হেতু স্থানীয় জনতার সচেতনতাহীন ভাবে নদীতে সার্ফ ডিটার্জেন্ট দিয়ে কাপড় কাচা। একবারও কেউ প্রশ্ন তুললেন না - পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের অফিসাররা কি অন্ধ ? তাঁরা কি দেখতে পাচ্ছেন না কস্ট কাটিং-এর জন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে কোনো ট্রিটমেন্ট না করেই বিষাক্ত কেমিক্যাল নদীতে ফেলা হচ্ছে ? একবারও কেউ বললেন না – সরকারের এই বিষয়ে ব্যবস্থা একটা নেওয়া দরকার। সাধারণ মানুষ না হয় প্রশ্ন তুললেন না, যা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তভ, সেই সংবাদমাধ্যমও মৌনতাই পরম ধর্ম মনে করল। এই একটা ঘটনা থেকেই বোঝা যায় বর্তমানে নগ্ন পুঁজিবাদ যে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে যুগলবন্দীতে ভারতের পরিবেশের চুড়ান্ত ক্ষতি করে চলেছে, তা নিয়ে বিশেষ হইচই হয় না কেন ? সরকারকে প্রশ্ন করা দূরে থাক, সাধারণ নাগরিকের, আরও স্পষ্ট করে বললে তথাকথিৎ ‘অপিনিয়ন মেকার’ মিডিয়া ও মধ্যবিত্তকুলে হাবভাব বরং উলটোটাই। প্রধাণমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কে United Nations Environment Programme বা U.N.E.P ‘Champion of the Earth’ সম্মানে ভূষিত করেছে এই খবরে এই দুয়ে মিলে যথেষ্ট উচ্ছাস প্রকাশ করা হয়েছে। মজার বিষয় হল সেটা নিয়ে প্রচুর সংবাদ দেখা গেলেও, প্রচুর আবেগ ভরা টুইট, পোস্ট নজরে পড়লেও Environmental Performance Index-এ ভারত যে ১৮০টা দেশের মধ্যে ১৭৭-তম স্থান অধিকার করেছে, তা নিয়ে না মিডিয়ার উচ্চবাচ্চ করেছে, না জনগণ। দেখা যায়নি গ্রীন ট্রাইবুন্যালের উপর সরকারের হস্তক্ষেপর প্রচেষ্টা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ বা ক্ষোভও। এই বিষয়ে বিরোধী দলগুলোও যেন অন্ধ ও বোবা। এই ক্ষুদ্র লেখাটির উদ্দেশ্য হল এই প্রেক্ষিতে অত্যন্ত কাঁচা অনভিজ্ঞ হাতে হলেও সেই নিরবতা ভঙ্গের কিছুটা চেষ্টা করা। আমি এই প্রসঙ্গে দুটি ভাগে আলোচনা করব। প্রথম অংশে আমি পরিবেশের ধ্বংসসাধনকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের গভীর থেকে গভীরতম হতে থাকা মধুচন্দ্রিমার সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ হাজির করব। দ্বিতীয় অংশে আমার আলোচ্য বিষয় হবে মার্কসবাদী দৃষ্টিতে এই অশুভ আঁতাতের বিশ্লেষণ।
মধ্য ভারতের ছত্তিশগড়ের হাসদেও আরান্দ জঙ্গল যদি একবার দেখেন, আপনার মনে হবে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে তা এখানেই-এখানেই-এখানেই। অত্যন্ত গভীর এই জঙ্গলটিকে ২০০৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রক সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে। ২০১৪ সালে ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া হাসদেও আরান্দ জঙ্গলকে ‘…inviolate from mining.’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করে। স্থানীয় পার্সা ইস্ট ও কেটে বসাও-এ যখন ক্যাপটিভ কোল মাইনিং ব্লক চালু হয়েছিল, তখনও ছত্তিশগড় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল কোনোভাবেই স্থানীয় হাসদেও আরান্দ এলাকায় হস্তক্ষেপ করবে না তারা মাইনিং-এর জন্য। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই দেখা গেল সে একেবারেই কথার কথা ।’ স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রামসভার অনুমতি অবধি নেওয়া হয় নি। একটা অনুমতিপত্র নামকাওয়াস্তে দেখানো হয়েছে বটে, কিন্তু অচিরেই দেখা গেছে অন্তত দুটো গ্রামের গ্রামসভার অনুমতিপত্র জাল। এই নিয়ে ‘ছত্তিশগড় বাঁচাও আন্দোলন’-এর প্রবল আপত্তি জানানো সত্ত্বেও সরকার কিন্তু পুঁজির স্বার্থ রক্ষার কাজ থেকে পিছিয়ে আসে নি। প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর অরণ্যের বুক বিদীর্ণ করে, সেখানকার আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকার কেড়ে রাজস্থান কোলিয়ারি লিমিটেডকে ইউনিয়ন এনভায়রনমেন্ট মিনিস্ট্রি অনুমতি দিয়েছে ওপেন কাস্ট কোল মাইন খোলার। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারের এত তাড়া কিসের যে নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে, আদিবাসীদের সাথে কথাও না বলে, জাল নথির উপর ভিত্তি করে তড়িঘড়ি এইরকম একটা সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়ে ফেললেন ? পরিষ্কার হয়ে যাবে রাজস্থান কোলিয়ারি লিমিটেডের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিলেই। এই কোম্পানিটি আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের একটি ইউনিট, এবং পরিবেশ ধ্বংস করে প্রোফিটের পেছনে দৌড়ানো এবং তার জন্য অনৈতিক পথ নেওয়া আদানি এন্টারপ্রাইজের কাছে নতুন কিছু যে না, সেটা শুধু ভারতের মানুষ না, অস্ট্রেলিয়ার মোট দেশও হাড়ে হাড়ে জানে। ওয়াকিবহাল মাত্রই এটাও জানেন আদানি গ্রুপের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার আর ভারতের শাসকদলের দহরম-মহরমের কথা। সুতরাং পুঁজিবাদী মুনাফার চাকায় জঙ্গল ও জঙ্গলের মানুষের অধিকার পিষ্ট হয়ে যাওয়া যে এই দেশের সরকার সমর্থন করবে তা আর আশ্চর্য কি ?
হাসদেও আরান্দের ঘটনা বিছিন্ন কিছু নয়। ব্রিটিশ আমলের শোষণমূলক অরণ্যনীতির যে ফাঁস আদিবাসীদের গলায় বসেছিল বর্তমান ভারত সরকার যেনতেন প্রকারেণ ভাবে সেই ফাঁসকে আরও এঁটে বসাতে বদ্ধপরিকর। ধরা যাক Indian Forest Act এর কথাই। সাম্প্রতিককালে, ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ব্রিটিশ আমলের এই আইনটির বেশ কিছু সংশোধন করতে সচেষ্ট হয়। যদিও প্রবল জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার পিছিয়ে এসেছে, প্রস্তাবিত সংশোধনী দেখে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না সরকারের বা আরও স্পষ্ট করে বললে সরকারের পরিচালক পুঁজিপতিদের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য কি। ২০০৬ সালের ফরেস্ট রাইট অ্যাক্টের মাধ্যমে আদিবাসী সমাজ যেটুকু অধিকার লাভ করেছিল, সেই সীমিত অধিকারও কেড়ে নেওয়াই সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য। F.R.A এ পরিষ্কার বলা হয়েছিল জঙ্গল ও অরণ্য-সম্পদ ব্যবহার, সংরক্ষণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে শেষ কথা বলবে আদিবাসী গ্রামগুলির গ্রামসভা। এই বিলের প্রধান উদ্দেশ্য এই জঙ্গলের জমিন ও সম্পদের ব্যবহার, সংরক্ষণ ও পরিচালনার শেষ কথা হিসেবে গ্রামসভার জায়গায় রাজ্য সরকার, ও ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ সরকার চায় জঙ্গলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ফরেস্ট ব্যুরোক্রেসির হাতে, আদিবাসীদের নয়। এর থেকেই পরিষ্কার F.R.A এর উদ্দেশ্য কখনই দীর্ঘমেয়াদী অধিকারের ভিত্তিভূমি নির্মাণ ছিল না, তা ছিল মাওবাদী প্রভাবকে প্রশমিত করার জন্য একটা পশ্চাদপসরণ মাত্র। যেই মুহূর্তে মাওবাদী প্রভাব দমন করা সম্ভব হয়েছে, পুঁজিবাদী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রযন্ত্র জঙ্গলের উপর তাদের পুরনো অধিকার ফেরত চাইছে। প্রস্তাবিত বিলটি খুঁটিয়ে দেখলে এটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। বিলের সেকশন ৫২(৩) অনুসারে অফিশিয়ালদের হাতে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার ও বলপ্রয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে, বিলের সেকশন ৬৬(A) তে দেওয়া হয়েছে গ্রাম সভার বা পঞ্চায়েতের কোনো অনুমতি ছাড়াই যে কারোর ঘরে ঢুকে খানতল্লাশি করার ক্ষমতা। ফরেস্ট অফিশিয়ালদের এইরকম AFSPA-এর মত ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব থেকে পরিষ্কার সরকারের উদ্দেশ্য আসলে কি।
পরিবেশের থেকে পুঁজির দিকে যে সরকারের নজর বেশী, তার আরেকটা পরিষ্কার উদাহরণ হল, এই ২০২০-তেই সরকারের এনভাইরনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেণ্টের ড্রাফট নোটিফিকেশন। এখানে ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রক প্রস্তাব দায়, যে সমস্ত শিল্প প্রকল্প যথাযথ এনভায়রনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স বা E.C ছাড়াই পরিবেশ ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে তারা শিল্প গড়ে তোলার পর জরিমানার বিনিময়ে (যার পরিমাণ সামান্য) ‘post-facto’ অনুমতি নিতে পারবে। এর মানে কি দাঁড়াল ? পরিবেশ মন্ত্রক বকলমে স্বীকার করে নিল, পরিবেশ রক্ষা করার কোনো সামর্থ্যই তাদের নেই। কর্পোরেট পুঁজি মুনাফার লোভে পরিবেশ ধ্বংস করে যা ইচ্ছে করতে পারে, তার পরিবর্তে সরকারকে এই অবৈধ মুনাফার একটা হিস্যা ‘জরিমানা’ হিসেবে দিলেই চলবে। তবে পরিবেশমন্ত্রকের কাছে এর থেকে আমাদের বেশী কিছু প্রত্যাশিতও বা ছিল কি ? গত পাঁচ বছরে প্রায় ১.০৯ কোটি গাছ কাটায় শিলমোহর দিয়েছে সরকারই, কিন্তু তার পরিবর্তে খাতায় কলমে compensatory afforestation-এর কাজ কতটা এগিয়েছে তার কোনো খবর নেই। আসলে আইন যাই হোক, সরকার পুঁজির স্বার্থে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতেই রাজি নয়। মহারাষ্ট্রের উদাহরণই দেখা যাক। C.A.G তার অডিট রিপোর্টে দেখিয়েছে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত মহারাষ্ট্র সরকার ৬৫ হাজার ৩৬৩ হেক্টর অরণ্যভূমি ১৬৭১-টি প্রোজেক্টের জন্য নির্দিষ্ট করেছে। কিন্তু এর পরিবর্তে যে বনসৃজন করার কথা তা নিয়ে সরকার কোনো উচ্চবাচ্চই করেনি। পুঁজির স্বার্থ রক্ষিত হয় না, এমন কাজে সময় ব্যয় করতে তাঁদের বয়ে গেছে।
এই পুঁজিবাদ ও পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতটা কাঠামোগত বা সিস্টেমিক। পুঁজিবাদের মূল বক্তব্য হল ‘সীমাহীন বৃদ্ধি’, কিন্তু এই বৃদ্ধির জন্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ প্রয়োজন তার পরিমাণ সীমিত। সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে একটি বড়ো অভিযোগ হল, তাঁরা বড্ড বেশী আইডিয়ালিস্ট, তাঁদের চিন্তা ভাবনা বাস্তবমুখী নয়। মজার বিষয় হল, এই অভিযোগ যারা করেন, তাঁরাই আবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ‘Infinite growth using finite resource’-এর রূপকথার গল্পে বিশ্বাস করেন। অনেক বিষয়ের মতো এই ক্ষেত্রেও প্রায় দেড়শো বছর আগে এক জার্মান দার্শনিক ও তাঁর সুহৃদ সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর বক্তব্য রেখেছেন। শুরুতে সেই কার্ল মার্কসের কথাই ধরা যাক। তিনি ব্রিটিনে পুঁজিবাদের সূত্রপাত হিসেবে কোন ঘটনাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ? ব্রিটিশ কৃষি বিপ্লব এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কমন ল্যান্ডের পরিবর্তে ল্যান্ড এনক্লোজার প্রথার সূচনাকে। এর ফলেই বিপুল পরিমাণ মানুষ তাঁদের প্রকৃতি ভিত্তিক চিরাচরিত জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে শহরে চলে আসেন রুটি রুজির আশায়। এই অসহায় জনগোষ্ঠীর শ্রম শোষণ করেই গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদের ভিত। এখানে গুরুত্ত্বপূর্ণ, মার্কস শুধু একটা নিছক যান্ত্রিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেননি, এটিকে প্রকৃতির সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবনের অবসান হিসেবেও দেখেছেন। একে মার্কস দেখেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের একরকম ‘Alienation’ হিসেবে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা অবিচ্ছেদ্য তা বোঝানোর জন্য মার্কস বলেছেন – ‘Man lives in nature – means that nature is his body, with which he must remain in continuous interchange if he is not to die. That man’s physical and spiritual life is linked to nature means simply that nature is linked to itself, for man is a part of nature.’ এই নিবিড় সম্পর্ককেই ছিন্ন করছে পুঁজিপতিদের মুনাফার লোভে। সেই লোভ তাঁর আমলেই মানুষকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মার্কস লিখেছেন – ‘Even the need for fresh air ceases to be a need for the worker. Man reverts once more to living in a cave, but the cave is now polluted by the mephitic and pestilential breath of civilization. Moreover, the worker has no more than a precarious right to live in it, for it is for him an alien power that can be daily withdrawn and from which, should he fail to pay, he can be evicted at any time….Light, air, etc. - the simplest animal cleanliness-ceases to be a need for man. Dirt – this pollution and putrefaction of man, the sewage of civilization – becomes an element of life for him. Universal unnatural neglect, putrefied nature, becomes an element of life for him.’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রভাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই বিচ্ছেদকে মার্কস রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেননি। ইতিহাসের গতি পেছনে ফেরানো যাবে না, এটা তিনি জানতেন। তাই তাঁকে কখনও বলতে শোনা যায় নি – ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তিনি একে দেখেছেন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থারই একটি সমস্যা হিসেবে হিসবে যা একমাত্র কোন ভবিষ্যৎ উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থার প্রণয়নের মাধ্যমেই সমাধান করা যেতে পারে। তিনি প্রকৃতিকে কারোর ব্যক্তিগত মালিকানা হিসেবে স্বীকার তো করেনই নি বরং সম্পূর্ণ সমাজ, রাষ্ট্ররও সম্মিলিত ভাবে বিশ্বপ্রকৃতির উপর মালিকানা তিনি অস্বীকার করেছেন। বরং তিনি মনে করেছেন, প্রকৃতির প্রতি মানুষের যৌথ কর্তব্য আছে। পরিবেশের ধ্বংসসাধনের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব যদি কোনো ব্যক্তির নিজের প্রজন্মে নাও অনুভূত হয় পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁর প্রকৃতি রক্ষায় কর্তব্যপরায়ণ হওয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর ভাষাতেই – ‘Even an entire society, a nation, or all simultaneously existing societies taken together, are not owners of the earth. They are simply its possessors, its beneficiaries, and have bequeath it in an improved state to succeeding generations.’
ভ্লাদিমির লেনিন বলেছিলেন মুনাফা হবে বুঝলে পুঁজিবাদী তার ফাঁসির দড়িও ফাঁসুড়েকে বিক্রি করতে পারে। সেই মুনাফার কিসের বদলে হচ্ছে সেই নিয়ে তাঁদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। অর্থাৎ তাঁদের ‘আরও বেশী জমা হয়ে থাকা চাই’-এর চক্রে যদি ফাঁসির দড়ি তাঁদেরই গলায় বসে, তা নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। ফলাফল দেখা যাচ্ছে হাতেনাতে। দুনিয়ায় কিউবা বা ভুটানের মোট স্বল্প কিছু দেশ ছাড়া সাস্টেইনেবেল ডেভেলোপমেন্টের দিকে কারোরই কোনো আগ্রহ নেই। সবাই চায় দ্রুত মুনাফা, দ্রুত বৃদ্ধি – তার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল যাই হোক না কেন। তাই তো বর্তমান পরিবেশ সংকটের মুখে পড়েও তথাকথিত উন্নত দেশগুলো তাঁদের সমস্ত প্রজ্ঞা নিয়েও নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানের পাঁচ পয়সা মুনাফার জন্য হাঁড়িকাঠে গলা দিচ্ছে পরবর্তী পাঁচ দশকের ভাবী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। এই প্রসঙ্গে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের বক্তব্যও এখানে প্রণিধান যোগ্য – ‘In relation to nature, as to society, the present mode of production is predominantly concerned only about the immediate, the most tangible result; and then surprise is expressed that the more remote effects of actions directed to this end turn out to be quite different, are mostly quite the opposite in character.’ ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন তিনি। মনে রাখতে হবে সময়টা হল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তখন এমনকি সব থেকে প্রগতিশীল চিন্তকরাও প্রকৃতির উপর মানুষের একচেটিয়া বিজয় প্রায় সম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, এঙ্গেলসের অবস্থান ছিল অবশ্যই বৈপ্লবিক – ‘Let us not however, flatter ourselves overmuch on account of our human victories over nature. For each victory nature takes its revenge on us….Each victory, it is true, in the first place brings about the results we expected, but in the second and third places it has quite different, unforeseen effects which only often cancel out the first.’ প্রায় দেড়শো বছর আগে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন বর্তমানে নেহাত জেনে বুঝে বোকা না সাজলে তা যে কোনো মানুষের চোখেই ধরা দেবে। বর্তমানে ইকো-সোশ্যালিজম নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টদের ‘গ্রিন নিউ ডিল’ বিশ্বে আলোড়ন তুলছে। দাবী উঠছে বিশ্ব জুড়ে পরিবেশকে জয় করার নয়, তার নিয়মগুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাঁচা ও বাঁচতে দেওয়ার। এই খবরগুলো পড়তে পড়তে সত্যিই অনেক সময় আশ্চর্য লাগে। হায়রে বিশ্ব, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে যাদের অবহেলা ভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে, তিন দশক যেতে না যেতেই তাদের আবার বের করে ঝেড়ে মুছে রাখতে হচ্ছে ? এঙ্গেলসের লেখাতেই আবার ফিরে যাই – ‘At every step we are reminded that we by no means rule over nature like a conqueror over a foreign people, like someone standing outside of nature…we have the advantage of all other creatures of being able to learn its laws and apply them correctly.’
সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি ভারতের প্রগতিশীল শক্তিগুলিকেও এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ও প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রশক্তির যুগলবন্দীকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, প্রচেষ্টা করতে হবে উৎপাদন ব্যবস্থা এমনভাবে বদলানোর যাতে যাকে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে ‘Metabolic Rift’ বলে চিহ্নিত করেছেন তাকে মেরামত করা যায়। এই লড়াই আক্ষরিক অর্থেই বাঁচার লড়াই। আমার, আপনার, মানবসভ্যতার। যদি এই লড়াই-এ প্রগতিশীলরা পরাস্ত হন, তাহলে বিপদ সারা বিশ্বের। এখনও যারা পুঁজিবাদের অনন্ত বৃদ্ধির গালগল্পে বিশ্বাস করেন, এবং তার জন্য পরিবেশ ধংসে এক পায়ে খাড়া, তাঁরা আমেরিকার ক্রি আদিবাসীদের মধ্যে একটি প্রচলিত প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত হলে উপকৃত হবেন – ‘When the last tree is cut down, the last fish eaten and the last stream poisoned, you will realize that you cannot eat money.’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন