প্রজিত জানার কবিতা
চিত্র- যোগেন চৌধুরী
ডায়েরি 2020 (এক)
আমি স্পষ্ট দেখলাম
মৃত্যুলিপি পেরিয়ে
এক অদৃশ্য সিঁড়ি
সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে।
অনেক ঊর্ধেব মেঘের তৈরী
সেই শৈশবের
হারিয়ে যাওয়া
চিলেকোঠা
বার বার
আমি ঢোকার চেষ্টা করি
কিন্ত দরজা ভিতর থেকে
আটকানো
আমি আমার শৈশবকে বলি
বলি আমার কৈশোরের মুগ্ধতাকে
বলি সারল্যকেও....দরজাটা একবার
খুলে দাও তোমরা
কি আছে ওখানে ?
কিছুই নেই
থাকলেও
তোমাকে বলার মতো কিছু নয়
অনেক অনেক বছর
হাওয়া ঢোকে নি সেই ঘরে
অনেক অনেক বছর
পৌঁছয় নি আলো
তোমরা তো জানতে
শৈশবের হারিয়ে যাওয়া ঘরে
এক নরম ফুসফুস থাকে .
এক ঝিমিয়ে পড়া রোগা শ্বাসনালী ...
দম বন্ধ হয়ে এলো।
কেউ একবার দরজাটা খোলো
আমি ওই ঘরে
ঢুকতে চাই একবার।
অনেক অনেক যুগ পর
আমি সেই
হারিয়ে যাওয়া ঘরটাকে
খুঁজে পেয়েছি।
ডায়রি 2020 (দুই)
শূন্য হাইওয়ে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ভারতবর্ষ
মাইলের পর মাইল
তিনশো, পাঁচশো , সাতশো , হাজার
হেঁটে যাচ্ছে শূন্য পথ, ধু ধু মাঠ, খোলা প্রান্তর
আর উষর উপত্যকা পেরিয়ে
জন্মভূমির ভিতর জন্মভূমি
ঘরের ভিতর আর এক ঘর
এক ভারতবর্ষ থেকে সব কিছু হারিয়ে
কারা যেন হেঁটে যাচ্ছে
আর এক ভারতবর্ষের দিকে
মাথার ওপর মার্চের সূর্যের আগুন ঝরানো হল্কা
পায়ের নীচে গলতে থাকা পিচ
গলা থেকে বুক পুড়তে থাকা পিপাসা, ক্ষরণ
তীব্র খিদেয় পাকস্থলীর ভিতর জড়িয়ে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি
নাড়িভুঁড়ির ভিতর জড়িয়ে যাওয়া যকৃত ও প্লীহা
কাঁধে শিশু ও বাক্স পেটরা, বাসনকোসন
আমরা, কোয়ারানটাইনে থাকা ভারতবর্ষ
কোনওদিন চিনতাম না এই ভারতবর্ষকে
চিনি না আজও।
অথচ কি আশ্চর্য দেখো
যে নিরাপদ আশ্রয়ের ভিতরে বসে
সামাজিক দূরত্ব মিশে যায় হাততালি,
শীতল প্রদীপ, আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া মোবাইল আলো
আর রোগমুক্তি কামনা করা আতসবাজির সাথে
তার প্রতি ইঁট ও দেয়াল ওদের তৈরি।
যে আট লেনের চকচকে রাস্তা দিয়ে
মাখনের ভিতর ছুরির মতো
ছয় গিয়ারের অটোমোবাইল ছুটে বেরায়
যে শপিং মল আর মাল্টি প্লেকসএ
রোজ সন্ধ্যা নামলেই জ্বলে ওঠে সভ্যতা
সে সবও ওদের বানানো।
ওদেরই বানানো ভারতবর্ষে
আজ আর ওদের কোনও জায়গা নেই।
আমরা যখন কোয়ারানটাইন
আমরা যখন নতুন রেসিপি
আমরা যখন খুব মন খারাপের সাথে
দুই পেগ টিচার্স , অন্ দা রকস্
ওরা তখন আট মাসের শিশু
আর সদ্য বিয়ে করা পরিবারকে নিয়ে
আবার খুঁজতে বেরিয়েছে
ওদের হারিয়ে যাওয়া দেশ।
ডায়েরি 2020 ( তিন)
মানুষ নেই । তবুও কারা সন্ধ্যা হলে
জ্বালিয়ে যায় বাতি । পাল্টে যায় শহর
রাতারাতি।
পাল্টে যায় পৃথিবীখানি
তোমার সাথে আমার পরিচয় । কিছুই আর
আগের মতো নয়।
রাস্তা ফাঁকা, ভীত কুকুর পাহারা দেবে কাকে
স্তব্ধ এই ভুতুড়ে মগ্নতার
অসহ শূন্যকে ?
সান্ধ্য ছাদ, শূন্য একা, এখনও দৃর শূন্যপুরে
তবুও দেখো
ভুতুড়ে বাতি জ্বলে
তবুও কোন্ অজানা পাখি
আতঙ্কিত শহর ছেড়ে
আকাশ থেকে আকাশে ডানা মেলে
শরীর থামে। থামতে চায়
তবুও মন ওড়ে । অলীক কোনও
মায়ার বন্দরে।
কোথাও কেউ নেই। শুধু মাথার ওপর
ভরসা দেওয়া
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
আকাশ ভরা
তারারা শুধু
থাকে।
ডায়রি 2020 (চার)
সাবধান। আপনার মৃত্যু আপনার কাছেই জমা থাক।
আর কারো জানার দরকার নেই।
আপনি কিছু দেখেন নি। মৃতদেহগুলি স্বপ্নের ভিতর এসেছিলো।
স্বপ্নের ভিতরেই হারিয়ে যাবে ।
মাত্র কয়েক দিন আগেই পূর্ণিমা ছিল।
আকাশ নক্ষত্র খচিত। তবু কে যেন ধোঁয়ায় ঢেকে দিয়েছিল
আপনার চোখ। সৎকার গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে
কবরখানার দিকে। ওই দেহগুলো কার?
আপনি কিছু দেখতে পান নি। আপনার শরীর এখন আর আপনার নয়। অন্য কারো চোখ দিয়ে
অন্য এক শরীর আপনার সামনে দিয়ে হেঁটে
ওই কবরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
কিছুটা আপনার মতোই দেখতে। শুধু চোখদুটো
যেন অন্য কারো বসানো।
আজকাল মৃতদেহও সংক্রামক। মৃত্যুও। স্বপ্নহীন সৎকারগাড়ি রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।
এক আশ্চর্য স্বপ্ন, যা আপনি নয়
আপনার হয়ে অন্য কেউ দেখেছিল একদিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন